Thursday 1 October 2009

বিরোধীদল সমর্থক কৃষকরা সার কেনা নিয়ে আতঙ্কে
রাজশাহীতে সার ডিলার নিয়োগে দলীয়করণ ও অনিয়মের অভিযোগ
অর্থনৈতিক প্রতিবেদক noya digonto 30/09/09

সময়মতো প্রয়োজনীয় সার কিনতে পারবেন কি না এ নিয়ে আতঙ্কের মধ্যে পড়েছেন সার দেশের বিরোধীদল সমর্থক লাখ লাখ কৃষক। কারণ রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত সরকারদলীয় খুচরা সার বিক্রেতারা আগামীকাল বৃহস্পতিবার থেকে কাজ শুরু করতে যাচ্ছেন। এমন পরিস্খিতির সৃষ্টি হলে সংশ্লিষ্ট কৃষকদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ফোকাস বাংলা নিউজ জানায়, দেশজুড়ে খুচরা সার বিক্রয়প্রতিনিধি নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়ম ও দলীয়করণের জন্য কৃষকদের মাঝে হতাশা ও শঙ্কা দেখা দিয়েছে। তারা বলছেন, সরকারের নতুন নীতিমালায় সার বিতরণ সুষ্ঠুভাবে হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। যথাসময়ে কৃষকরা সার পাবেন না বলে তার আশঙ্কা করছেন। দীর্ঘদিন খুচরা বিক্রেতা হিসেবে পরিচিত প্রকৃত ব্যবসায়ীদের বঞ্চিত করে সরকারি দলের নেতাদের ইউনিয়নভিত্তিক খুচরা বিক্রয়প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কৃষি বিভাগের নিয়মনীতি অনুসরণ করে আবেদনের পরও বঞ্চিত হওয়ায় পুরনো ও অভিজ্ঞ ব্যবসায়ীদের মাঝে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। এতে যথাসময়ে ন্যায্যমূল্যে সার পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ফলে কৃষকদের মাঝে চরম হতাশা ও ক্ষোভ বিরাজ করছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, নতুন নীতিমালায় আগের নিয়োগ পাওয়া পাঁচ হাজার ১১১ জন ডিলারের নিয়োগ বহাল থাকলেও তাদের কোনো বিক্রয়প্রতিনিধি থাকবে না। তাদের অধীনে আগে থাকা ১৫ হাজার ৩২৭ জন বিক্রয়প্রতিনিধির নিয়োগ বাতিল বলে গণ্য হবে। বিক্রয়প্রতিনিধির পরিবর্তে স্খানীয়ভাবে বিশেষ আইডি কার্ডধারী খুচরা বিক্রেতা নিয়োগের বিধান রাখা হয়েছে নতুন নীতিমালায়। এ ছাড়া ইউনিয়ন পর্যায়ে একাধিক নতুন ডিলার নিয়োগ দেয়ার ব্যবস্খা রাখা হয়েছে। ইউনিয়ন ও পৌরসভায় ডিলার নিয়োগের ক্ষেত্রে স্খানীয় বাসিন্দাদের অগ্রাধিকার দেয়া হবে।
জানা গেছে, সার বিতরণ ব্যবস্খায় বিদ্যমান জটিলতা নিরসন করে কৃষকের কাছে যথাসময়ে সার তুলে দেয়া নিশ্চিত করতে আগামীকাল বৃহস্পতিবার থেকে সারা দেশে সার ডিলার নিয়োগ ও বিতরণ সংক্রান্ত সমন্বিত নীতিমালা-২০০৯ কার্যকর হচ্ছে। নতুন নীতিমালায় আগে নিয়োগ পাওয়া ডিলারদের নিয়োগ বহাল রাখা হলেও তাদের কোনো বিক্রয়প্রতিনিধি থাকছে না। খুচরা সার বিক্রির ক্ষেত্রে আইডি কার্ড পদ্ধতি চালু করা হচ্ছে। উপজেলা সার ও বীজ মনিটরিং কমিটি খুচরা সার বিক্রির জন্য মনোনীতদের এই আইডি কার্ড প্রদান করবে।
নীতিমালায় পরোক্ষভাবে খুচরা বিক্রেতা নিয়োগে সংসদ সদস্যদের হাতে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। জেলার সব সংসদ সদস্য সার বিক্রেতা বাছাই কমিটি ও উপজেলা সার-বীজ মনিটরিং কমিটির উপদেষ্টা থাকবেন। একই সাথে ইউপি চেয়ারম্যানের নেতৃত্বাধীন বিক্রেতা বাছাই কমিটিতেও স্খানীয় এমপি’র মনোনীত প্রতিনিধি থাকছে। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র দাবি করেছে, নতুন নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে সারা দেশে কৃষকরা স্খানীয় বাজার থেকে তাদের চাহিদা মতো সার কিনতে পারবেন।
আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে সার বিতরণ ব্যবস্খায় জটিলতা নিরসনে খুচরা সার বিক্রেতা নিয়োগ পদ্ধতি প্রবর্তন করেছিল। পরে বিএনপি সরকার সেই পদ্ধতি বাতিল করে। নয়া নীতিমালা কার্যকরের মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকার সার বিক্রেতা নিয়োগে তাদের আগের পদ্ধতিতে ফিরে যাচ্ছে।
ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলার এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফোকাস বাংলা নিউজকে বলেন, তিনি দীর্ঘ ২০ বছর খুচরা বিক্রেতা হিসেবে সার বিক্রি করছেন। এত দিন তিনি বিসিআইসি কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত এক ডিলারের অধীনে সাব-ডিলার ছিলেন। নতুন পদ্ধতিতে সার বিতরণের নীতিমালায় তার সাব-ডিলারশিপ বাতিল হয়ে যায়। সম্প্রতি কৃষি অধিদফতরের নিয়ম মেনে তিনি খুচরা বিক্রেতা হিসেবে নিয়োগের জন্য আবেদন করেন। পুরনো ও অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী হয়ে আবেদন করেও তিনি খুচরা বিক্রেতা হিসেবে নিয়োগ পাননি। সেখানে আওয়ামী লীগের পৌরসভার এক নেতাকে খুচরা বিক্রেতা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। দত্তের বাজার ইউনিয়নের এক পুরনো ব্যবসায়ী জানান, তিনি প্রত্যেক বছর কৃষি অধিদফতরের শর্ত মেনে ১৫ বছর ধরে সার বিক্রি করছেন। আওয়ামী লীগ সমর্থিত ব্যবসায়ী হওয়ায় বিগত জোট সরকারের সময় তাকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হয়েছে। ক্রয়মূল্যের চেয়ে প্যাকেটপ্রতি ৫০ টাকা লোকসান দিয়েও তাকে সার বিক্রি করতে হয়েছে। তবুও তিনি ব্যবসা বìধ করেননি। কিন্তু মহাজোট সরকার নতুন নীতিমালা করায় এ বছর থেকে তিনি আর সার বিক্রয় করতে পারবেন না। তিনি জানান, উপজেলা কৃষি অধিদফতর থেকে খুচরা বিক্রেতা নিয়োগ পেতে আবেদন করার জন্য তাকে অবহিত করা হয়নি। সরকারদলীয় দুইজন নেতা যারা কখনোই ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন না, এমন ব্যক্তিকে স্খানীয় সংসদ সদস্য খুচরা বিক্রেতা হিসেবে নিয়োগ দিতে সুপারিশ করেন। বগুড়ার গাবতলী উপজেলার এক ব্যবসায়ী জানান, জেলা কৃষি অধিদফতর থেকে নিয়োগের সুপারিশ করা হলেও তিনি সরকার সমর্থিত ব্যবসায়ী না হওয়ায় তাকে খুচরা বিক্রেতা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়নি। সারা দেশে খুচরা বিক্রেতা নিয়োগে একই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এতে ব্যবসায়ীদের মাঝে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
রাজশাহীর বাঘমারা উপজেলার কৃষক ফরিদ উদ্দিন বলেন, সার বিক্রয়ে খুচরা বিক্রেতা নিয়োগে সরকারদলীয় নেতাদের যেভাবে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে তাতে সার নিয়ে নতুন করে কেলেঙ্কারির আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, খুচরা বিক্রেতারা দলীয় লোকদের অগ্রাধিকার দিয়ে সার বিক্রি করবে। বিরোধী দলের সমর্থন করেন এমন কৃষকদের মাঝে সার বিক্রয় করা হবে না। ফলে সারের অভাবে ফসল উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হবে। তাতে দেশের কৃষিতে বড় ধরনের ধস নেমে আসবে। নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের সিরাজপুর ইউপি’র কৃষক হাফিজ উদ্দিন বলেন, দীর্ঘদিন এলাকায় সার বিক্রি করছেন এমন ব্যবসায়ীরা খুচরা বিক্রেতা হিসেবে নিয়োগ পাননি। ইউনিয়নের সরকারি দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বিক্রয়প্রতিনিধি নিয়োগ পেয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে সাধারণ জনতার কাছ থেকে প্রতারণা করে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ ধরনের ব্যক্তিরা সার বিক্রেতা নিয়োগ পাওয়ায় কৃষকদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে।
সার ও বীজ মনিটরিং বিভাগের মহাপরিচালক এ ব্যাপারে জানান, সরকার সহজ উপায়ে কৃষকদের মাঝে সার পৌঁছে দিতেই আগের ডিলারদের বহাল রেখে ইউনিয়নভিত্তিক সাতজন খুচরা প্রতিনিধি নিয়োগ দিয়েছেন। ইউপি চেয়ারম্যানদের দেয়া তালিকা যাচাই-বাছাই করে উপজেলা সার ও বীজ মনিটরিং কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে প্রকৃত ব্যবসায়ীদেরই নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এতে দলীয় বা বিশেষ কোনো পদ্ধতিকে প্রাধান্য দেয়া হয়নি।
রাজশাহী ব্যুরো জানায়, রাজশাহীতে আওয়ামী লীগপন্থী নতুন ৬০২ জন খুচরা সার ডিলার নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়েছে।
নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত এই ডিলারদের মাধ্যমে এ সার দেয়া হবে বলে জানা গেছে। নিয়োগপ্রাপ্ত ডিলার ছাড়া অন্য কেউ সার বিক্রি করতে পারবে না। আগামীকাল বৃহস্পতিবার থেকে নতুন নীতিমালা অনুযায়ী কৃষকদের মাঝে সার বিতরণ কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নতুন নীতিমালায় রাজশাহী জেলায় নতুন করে ৬০২ জন খুচরা সার ডিলার নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়। জেলায় ৮৯ জন বিসিআইসি ডিলারের অধীনে এই খুচরা ডিলাররা কৃষকদের কাছে সার বিক্রি করবেন। অভিযোগ উঠেছে, ডিলার নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাপক দলীয়করণ করা হয়েছে। সেই সাথে বিপুল অর্থের লেনদেন হচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্য মতে, জেলার নয় উপজেলায় চলতি মাসে কৃষক পর্যায়ে সার বিতরণের জন্য ডিলার বা বিক্রয়প্রতিনিধি নিয়োগের আহ্বান করা হলে প্রায় ২০ হাজার আবেদন জমা পড়ে। এসব আবেদনকারীদের মধ্য থেকে নিয়োগ কমিটির মাধ্যমে যাচাই-বাছাইয়ের পর ৬০২ জনকে খুচরা ডিলার হিসেবে নিয়োগ দানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে এতে শুধু আওয়ামীপন্থীরাই সুযোগ পান। এসব ক্ষুদ্র ডিলার তথা বিক্রয়প্রতিনিধির কাছ থেকে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা নেয়া হচ্ছে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাদের সাথে যোগসাজশ করে এমপি’র মনোনীত আওয়ামী লীগ নেতারা এ ধরনের অনিয়ম চালিয়ে যাচ্ছেন বলে বিস্তর অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সূত্র মতে, চলতি মাসের মধ্যেই এ নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করবে কৃষি বিভাগ। এরপরই নতুন ডিলারের মাধ্যমে কৃষক পর্যায়ে সার বিতরণ করা হবে। এ জন্য জেলার প্রত্যেক ইউনিয়ন ও পৌরসভার প্রতিটিতে সাতজন করে খুচরা ডিলার নিয়োগ করছে কৃষি বিভাগ।
রাজশাহী জেলার বাগমারা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শেখ মুহাম্মদ আলমগীর জানান, উপজেলার ১৮টি ইউনিয়ন ও পৌরসভায় সাতজন করে মোট ১২৬ জন ডিলার নিয়োগ করা হবে। তবে এর অনুকূলে আবেদন জমা হয়েছে ৩৯৭টি। জমাকৃত আবেদনগুলো সংশ্লিষ্ট ইউপি ও পৌর কমিটির কাছে পাঠানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কমিটির যাচাইকৃত আবেদনগুলোই উপজেলা কমিটি চূড়ান্তভাবে নিয়োগ করবে। একইভাবে জেলার নয় উপজেলায় ২০৬ জন খুচরা ডিলার নিয়োগ-প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় সার বিক্রি শুরু হলে কৃষকরা সঠিক দামে ও সহজে সার পাবেন বলে আশা করছেন কৃষি সংশ্লিষ্টরা।
নতুন নীতিমালায় জেলা প্রশাসনের সহায়তায় বিসিআইসি’র মাধ্যমে জেলাওয়ারি গুদাম স্খাপন করা, গুদাম থেকে সার সরবরাহের ব্যবস্খা নিশ্চিতসহ বিভিন্ন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া জেলার সব সংসদ সদস্য সার বিক্রেতা বাছাই কমিটি এবং উপজেলা সার ও বীজ মনিটরিং কমিটির উপদেষ্টা থাকবেন। একই সাথে জেলা সার ও বীজ মনিটরিং কমিটিতে জেলার সব উপজেলা চেয়ারম্যান ও নির্বাহী কর্মকর্তা ও সীমান্তবর্তী জেলা-উপজেলার বিডিআর প্রতিনিধিকে কমিটিতে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক জেলা পর্যায়ের কমিটিতে সভাপতি থাকবেন।
গতকাল রাজশাহীর জেলা প্রশাসক শেফাউল দাবি করেন, অনিয়ম হলে ইউনিয়ন পর্যায়ে হতে পারে। জেলা পর্যায়ে এ ধরনের অনিয়মের কোনো সুযোগ নেই।

No comments:

Post a Comment