Thursday 1 October 2009

সরকার সমর্থকদের আচরণে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীতে অস্খিরতা
আবু সালেহ আকন


সরকারি দল সমর্থকদের আচরণে অস্খির হয়ে উঠেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, নারী নির্যাতনসহ নানা অপরাধের সাথে সরকার সমর্থকরা উদ্বেগজনকহারে জড়িয়ে পড়ছে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে। এতে ক্রমেই দেশের স্বাভাবিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্খিতির অবনতি ঘটছে। এ অবস্খায় মানবাধিকার কর্মীরা বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দুষ্টের লালন ও শিষ্টের দমন করছে। সরকার সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা প্রদানে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে।
সূত্রাপুরে দুর্গাপূজার প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে ফেরার পথে গত সোমবার রাতে গুলিতে খুন হয়েছেন গৌতম সরকার নামের এক স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা। সূত্রাপুর থানা পুলিশ বলেছে, পূজামণ্ডপের কর্তৃত্ব নিয়ে বিরোধকে কেন্দ্র করে এই খুন ঘটেছে। তবে স্খানীয় সূত্র জানিয়েছে, এ ঘটনা ঘটেছে হিন্দু সম্প্রদায়ের জমি জবরদখলকে কেন্দ্র করে। এর সাথে সরকার সমর্থকরাই জড়িত বলেও স্খানীয় সূত্র জানায়।
এভাবে সারা দেশেই ঘটছে খুন-খারাবি, জমি দখল, ভাঙচুর ও চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বেশির ভাগ ঘটনার সাথেই সরকার সমর্থকরা জড়িত।
অনুসìধানে দেখা গেছে, সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে নারী নির্যাতন। ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কিছু নেতাকর্মী এই ঘটনার সাথে জড়িয়ে পড়ছে। নারীদের শ্লীলতাহানি করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি, ওই অপকর্মের ভিডিও করে তা সিডি করে বাজারজাত পর্যন্ত করেছে তারা। পিরোজপুরে এরূপ বেশ কিছু সিডি উদ্ধার করেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্খার সদস্যরা। প্রেমের ফাঁদে ফেলে পিরোজপুর জেলা ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক আহসান কবির মামুন ওরফে টাইগার মামুনের নেতৃত্বে এক স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের চিত্র রয়েছে ওই সিডিতে। সম্প্রতি নাজিরপুর কলেজ শাখার সভাপতি তরিকুল ইসলাম সেন্টুর নেতৃত্বে একই কলেজের এক ছাত্রীকে গণধর্ষণ করে উপজেলা বন বিভাগের নার্সারির মধ্যে ফেলে রাখে। এসব ঘটনায় মামলা হলেও হোতারা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় গত রোববার রাতে সপ্তম শ্রেণীর এক ছাত্রীকে গণধর্ষণ করেছে স্খানীয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ১০ নেতাকর্মী। এ ঘটনায় আওয়ামী লীগ নেতারা সালিস করে দিয়েছেন। ১০ জনকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা এবং ১০০ বেত্রাঘাত শাস্তি হয়েছে। লোকলজ্জা ও সরকারি দলের ভয়ে ওই ছাত্রীর পরিবার কোনো মামলা দায়ের করেনি। পুলিশও এ বিষয়ে মামলা নিতে উদ্যোগী হয়নি।
গত রোববার রাতে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া তুষখালী বাজার পূজামণ্ডপে তরুণীদের উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করেন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক আজমল হক হেলাল। সন্ত্রাসীরা তখন তার ওপর হামলা চালায়। তাদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে তিনি আহত হন। হেলাল জানান, ঘটনাস্খলে পুলিশ মোতায়েন থাকলেও তারা সন্ত্রাসীদের আটক করতে অপারগতা প্রকাশ করে।
গত ২৬ সেপ্টেম্বর এক তরুণী রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর বেড়িবাঁধ এলাকায় ঘুরতে যায়। সেখানে সেন্টু, মিজান ও পলাশ নামের তিন সন্ত্রাসী তরুণীকে জোর করে নৌকায় তুলে পালাক্রমে নির্যাতন চালায়। পরে তাকে অজ্ঞান অবস্খায় বাঁধের ওপর ফেলে যায় সন্ত্রাসীরা। স্খানীয় মাতব্বররা এ ঘটনার বিচার করে দেয়ার কথা বলে থানায় মামলা না করার নির্দেশ দেয়। গত ২৭ সেপ্টেম্বর বিকেলে বিচার বসানোর কথা বলে স্খানীয় কিলার সালাহউদ্দিন ওই কিশোরীকে বাসা থেকে নিয়ে যায়। সেখানে আবারো তার ওপর পাশবিক নির্যাতন চলে। স্খানীয় সূত্র জানিয়েছে, নির্যাতনকারীরা স্খানীয় সরকারদলীয় নেতাকর্মী। ওই কিশোরী থানায় মামলা দায়ের করতে গেলে পুলিশ তাকে থানা থেকে বের করে দেয়।
কামরাঙ্গীরচরের অপর ঘটনাটি ঘটেছে রসুলপুরের দেড় নং গলি এলাকায়। স্খানীয় সূত্র জানায়, স্খানীয় আওয়ামী লীগ নেতা পরিচয়দানকারী মিন্টু মোল্লা ওই এলাকার এক তরুণীকে ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আটকে রেখে নির্যাতন চালায়। পুলিশ তাকে উদ্ধার করতে গেলে আওয়ামী লীগ নেতা কালা মনসুর বিষয়টি ‘সালিস’ করে দেয়ার কথা বলে। ২৭ সেপ্টেম্বর রাতে তিন নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে সালিস বসে। সেখানে ইউসুফ, মনসুর, কালা বাবুল, কালা মজিবর ও কানা কাদির উপস্খিত ছিল। সালিস বৈঠকে মিন্টু মোল্লার বিচার না করে উল্টো স্খানীয় যুবক মঈনকে ১৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন। আওয়ামী লীগেরই কিছু নেতা-নেত্রী এর প্রতিবাদ করলে সালিসদাররা তাদের বৈঠক থেকে বের করে দেয়।
মানবাধিকার কর্মীরা বলেছেন, সম্প্রতি সরকার সমর্থকরা যা করছে তা নি:সন্দেহে উদ্বেগের। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট আদিলুর রহমান শুভ্র নয়া দিগন্তকে বলেন, নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় গেলেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয় না। গণতন্ত্রের লক্ষ্য হচ্ছে মানবাধিকার রক্ষা করা। বর্তমান সরকারের ছাত্র ও যুবলীগ ভয়াবহ পরিস্খিতি সৃষ্টি করে রেখেছে।
আদিলুর রহমান বলেন, সাধারণ মানুষ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কাছে যেতে পারে না। তারা দুষ্টের লালন ও শিষ্টের দমন করছে। তিনি বলেন, এই পরিস্খিতিতে গণপ্রতিরোধ ছাড়া মুক্তির পথ নেই। সাধারণ মানুষের পক্ষে কথা বলার কেউ নেই। দু-একটি পত্রপত্রিকা ও মানবাধিকার সংগঠন এই পরিস্খিতির বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে তারাও কোণঠাসা।
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট এলিনা খান নয়া দিগন্তকে বলেন, সন্ত্রাসীদের কোনো দল নেই। ছাত্রলীগ-যুবলীগ যা করছে তা সরকারের নামের ওপর কলঙ্ক ফেলছে। তিনি বলেন, নিজ সুনাম রক্ষা করতে হলে সরকারের উচিত ওসব ঘটনার সাথে জড়িতদের গ্রেফতার করা। তিনি এসব ঘটনার নিন্দা, প্রতিবাদ ও ঘৃণা প্রকাশ করে বলেন, ঘটনার সাথে জড়িতদের এক্ষুনি গ্রেফতার করা প্রয়োজন।
পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, বিভিন্ন ঘটনায় তারাও উদ্বিগ্ন। এভাবে চলতে থাকলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্খিতির মারাত্মক অবনতি ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।

No comments:

Post a Comment