Saturday, 11 April 2009

জৈবিক সত্তা এবং রাজনৈতিক জীবন

আমাদের সমাজে রাষ্ট্র, রাজনীতি, আইনের সঙ্গে মানুষের জৈবিক সত্তার সম্পর্ক সংক্রান্ত ধারণাগুলোকে প্রশ্ন করবার- চিন্তার দরবারের সওয়াল-জবাব করবার তৌফিক আমরা এখনো অর্জন করিনি। মানুষ আধুনিক রাষ্ট্রে শুধুই কি ‘নাগরিক’? তার রাজনৈতিক পরিচয়ই কি শেষ কথা, নাকি মানুষ একই সঙ্গে প্রাণ বা জীবও বটে। যে জীবের জীবন নিয়ে মানুষ প্রাণসম্পন্ন হয়ে বাঁচে সেই জীবনের সঙ্গে মানুষের রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রীয় জীবনের সম্পর্ক কোথায়? রাষ্ট্র, আইন ও নাগরিকতার সঙ্গে প্রাণের বা মানুষের জীবনের সম্পর্কটা আসলে কী ? বলা হয়ে থাকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে ওঠে জনগণের ইচ্ছা ও সংকল্পের ওপর, সংবিধান যার অভিব্যক্তি। তাহলে জীবনের অবস্থানটা এখানে কোথায়? জীবনের সঙ্গে জীবনের ইচ্ছা ও সংকল্পের? মানুষ কি শুধু ইচ্ছা ও সংকল্পবান মাত্র? মানুষের জীবের জীবন বা প্রাণের জায়গাটার সঙ্গে তার রাজনৈতিক জীবন ও পরিমণ্ডলের ভেদচিহ্ন ঠিক কোথায়? কীভাবে এই ভেদটা ঘটল? সেই তর্ক রয়ে গেছে। রাজনৈতিক ইচ্ছা ও সংকল্পের সঙ্গে নাগরিকদের প্রাণ ও জীবনের সম্পর্ক এই কালে গুরুতর প্রশ্ন হয়ে এখন হাজির হয়েছে। নাগরিকদের প্রাণ বা জীবন রাষ্ট্রের রাজনৈতিকতা বা নাগরিকদের রাজনৈতিক অস্তিত্বের সাথে কোথায় ও কীভাবে সম্পৃক্ত সেটা এই কালে প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্র হত্যা করতে পারে, কিন্তু সেটা করতে পারে আইনের অধীনে এবং স্বচ্ছ আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে- এই অনুমান এবং এই অনুমানের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা ‘রাষ্ট্র’ সংক্রান্ত ধারণার গোড়ায় কোনো মুশকিল আছে কি না সেটা বিচারের দরকার হয়ে পড়েছে।

আসলেই। রাষ্ট্র নাগরিকদের জীবন হরণ করতে পারে- রাষ্ট্রের এই সার্বভৌম ক্ষমতা সম্পর্কে আমরা খানিক সচেতন হয়ে উঠলেই একটা অস্বচ্চি তৈরি হয়। ‘সার্বভৌমত্ব’ বলতে আমরা যা বুঝি সেই বোঝাবুঝির ক্ষেত্রেও সংকট তৈরি হয়। সেটা আরো তীব্র হয়ে ওঠে যখন দেখা যায় রাষ্ট্র ও আইন সংক্রান্ত প্রচলিত তত্ত্ব বা ধারণার মধ্যে এই অস্বস্তির সুরাহা হয় না। সেটা বুর্জোয়া রাষ্ট্র চিন্তাই হোক, কিংবা হোক মার্কসীয় রাষ্ট্রের ধারণা। দুটো ধারণাই কথাকথিত ‘আধুনিক’ রাষ্ট্রের, কারণ উভয় ধারণার মধ্যে রাষ্ট্র নাগরিকদের জীবন হরণ করতে পারে এই অনুমান সক্রিয়। মার্কসের রাষ্ট্র ধারণার মধ্যে রাষ্ট্র হচ্ছে শ্রেণীবিভক্ত সমাজের অভিব্যক্তি। শ্র্রেণী শোষণের বিলোপের মধ্য দিয়ে সমাজের মধ্য থেকে তৈরি হয়ে সমাজের ঊর্ধ্বে উঠে যাওয়া রাষ্ট্র আবার সমাজের মধ্যেই বিলীন হয়ে যাবার - অর্থাৎ ‘শুকিয়ে মারবার’ কথা। এই প্রতিশ্রুতি মার্কস আমাদের দিয়েছেন। বলাবাহুল্য, মার্কসের ‘সার্বভৌমত্ব’ সংক্রান্ত ধারণা শ্রেণীর প্রশ্ন বাদ দিয়ে নয়। তাহলে সে সার্বভৌম ক্ষমতার বলে রাষ্ট্র নাগরিকদের প্রাণ হরণ করতে পারে সেই সার্বভৌমত্ব কোনো চিরকালীন বা শাশ্বত ব্যাপার নয়। রাষ্ট্রই যদি না থাকে, যদি বিলীন হওয়াই রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক নিয়তি তাহলে সার্বভৌমত্বও আর কিসের? কিন্তু মার্কস নিজে প্রশ্নটি আমরা যে জায়গা থেকে তুলছি, সেই অবস্থান থেকে তোলেননি। প্রচলিত মার্কসবাদও নয়। আমরা বড়জোর আন্দাজ করতে পারি মার্কসের রাষ্ট্র বা সার্বভৌমত্ব সংক্রান্ত ধারণা সুনিি র্দষ্ট ঐতিহাসিক বাস্তবতার সঙ্গেও যুক্ত। যে বাচ্চবতার মধ্যে রাষ্ট্র নাগরিকদের প্রাণ হরণ করতে পারে এবং এই পারাটাকে স্বাভাবিক মনে করে, রাষ্ট্রের বিলয়ের মধ্য দিয়ে সেই বাচ্চবতা এবং তার সঙ্গে যুক্ত সকল ধারণারও বিলয় ঘটবে। কিন্তু ঘটবেই সেই দাবি করবার কোনো পদ্ধতিগত বা তত্ত্বগত দিকনির্দেশনা মার্কস বা মার্কসবাদের মধ্যে আমরা পাই না। অর্থাৎ পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিলয় ও রাষ্ট্রসকল শুকিয়ে মরার পরে ঠিক কী ঘটবে বা ঘটতে পারে সেই বিষয়ে আমরা চিন্তাই শুরু করিনি।

কিন্তু বড়লোকের রাষ্ট্র ও বড়লোকের আইনকে ভেঙে সংখ্যাগরিষ্ঠের বিধান বা গণতন্ত্র কায়েম করতে হলে বলপ্রয়োগের প্রশ্নকে আমরা আলোচনার বাইরে রাখতে পারি না। ওয়ালটার বেনজামিন যে কারণে তাঁর প্রখ্যাত নিবন্ধ ‘বলপ্রয়োগ বিচার’-এর শুরুতেই বলছেন, বলপ্রয়োগের বিচারের দায় অল্পকথায় আইন ও ইনসাফের সাথে তার সম্পর্ক বিশদ করে মেটানো যায়।’ অর্থাৎ বলপ্রয়োগের প্রশ্ন বিদ্যমান আইন ও সংবিধান বা রাষ্ট্রের বিপরীতে নতুন আইন, সংবিধান বা রাষ্ট্রের আবির্ভাবের প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত। বিদ্যমান আইন, সংবিধান বা রাষ্ট্রের চোখে তার প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি যখনই রাষ্ট্রের বলপ্রয়োগের ক্ষমতার ওপর একচেটিয়া বহাল রাখাকে চ্যালেঞ্জ করে তখন রাষ্ট্র তাকে সবসময়ই ‘সন্ত্রাসী’ বলতে বাধ্য। তাই নয় কি ? ‘কমিউনিস্ট’ বা ‘ইসলামপন্থি’ উভয়েই রাষ্ট্রের চোখে সন্ত্রাসী। অন্যদিকে বিদ্যমান রাষ্ট্র তার প্রতিপক্ষের চোখে অন্যায় রাষ্ট্র- তাকে টিকিয়ে রাখার কোনোই যৌক্তিকতা নাই। কি আদর্শ বাস্তবায়ন করবার জন্য বলপ্রয়োগ করা হলো বা বলপ্রয়োগ নীতিনৈতিকতার দিক থেকে ভালো কি মন্দ- সেই সকল তর্ক ওয়ালটার বেনজামিন দেখিয়েছেন আইন ও ইনসাফের সঙ্গে সম্পর্ক বিচারের দিক থেকে অপ্রাসঙ্গিক। আমরা নৈতিক দিক থেকে অহিসংবাদী হতেই পারি। নীতিগতভাবে বলপ্রয়োগ পছন্দ না করবার যথেষ্ট কারণ আমাদের থাকতে পারে। কিন্তু নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বলপ্রয়োগের সঙ্গে আইন ও ইনসাফের সম্পর্ক বুঝতে আমাদের সহায়তা করে না। অন্যদিকে আবার বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব, সমাজতান্ত্রিক বা কমিউনিস্ট বিপ্লবের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য বলপ্রয়োগ ‘ভালো’ বা সেটা ইতিবাচক অর্থে ‘বিপ্লবী কর্মকাণ্ড’- আর, ইসলামি বিপ্লব- যাদের আদর্শ ও উদ্দেশ্য আমরা পছন্দ করি না- সেই উদ্দেশ্য বাচ্চবায়নের জন্য বলপ্রয়োগ ‘মৌলবাদী’ ও মন্দ- উদ্দেশ্য দিয়ে বলপ্রয়োগ বিচারের এই পদ্ধতিও ওয়ালটার বেনজামিন দর্শনের জায়গা থেকে নাকচ করে দিয়েছেন। ঠিক তেমনি অসম, শোষণমূলক ও গরিবের ওপর ধনীর আধিপত্য বহাল রাখবার জন্য বলপ্রয়োগ মানেই ‘শান্তি’ রক্ষা ও সন্ত্রাস দমন- এই ধারণাও বিদ্যমান ব্যবস্থার সুবিধাভোগীদের ধারণা মাত্র- এই সহজ ব্যাখ্যাও যথেষ্ট নয়। বিদ্যমান আইন বা রাষ্ট্র বলপ্রয়োগ ছাড়া এবং বলপ্রয়োগের ওপর নিজের একচেটিয়া বহাল না রেখে টিকে থাকতে পারে না। আইন মাত্রই বলপ্রয়োগের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, বলপ্রয়োগ ও আইনের এই সম্পর্ক দার্শনিক পর্যালোচনায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বলপ্রয়োগের প্রশ্নকে হাজির করতে হবে আইন ও ইনসাফের সঙ্গে তার সম্পর্ক বিচার করে। কোন উদ্দেশে বলপ্রয়োগ করা হলো বা হচ্ছে সেই উদ্দেশ্য বিচার করে বলপ্রয়োগের নিজস্ব স্বভাব আমরা ধরতে পারব না। বলপ্রয়োগের নিজস্ব চরিত্র ও ভূমিকাও আমরা বুঝব না।

এবার আসা যাক জীবের জীবন আর রাজনীতি- অর্থাৎ যে জীবন রাষ্ট্র বা সার্বভৌম ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত সেই বিষয়ে দুই-একটি কথা।



২.

গ্রিক ভাষায় ‘জন্তু’ (ুড়ব) ও জীবন (নরড়ং) দুটো ভিন্ন শব্দ, তাদের মানেও আলাদা। প্লেটো তাঁর চযরষবনঁং-এ তিন ধরনের ‘জীবন’ নিয়ে কথা বলেছেন। এরিস্টটল সেই প্রসঙ্গে তিন ধরনের জীবন নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তাদের পাথর্ক্য নিয়েও আলোচনা করেছেন। এক ধরনের জীবন হলো তত্ত্বচর্চার বা দার্শনিকের জীবন (নরড়ং ঃযবৎবঃরশড়ং) ; ভোগ বা বিনোদনের জীবন (নরড়ং ধঢ়ড়ষধঁংঃরশড়ং) এই জীবন থেকে আলাদা। ঠিক তেমনি রাজনৈতিক জীবন (নরড়ং ঢ়ড়ষরঃড়শড়ং) অন্য দুই জীবন থেকে আলাদা। লক্ষ করার বিষয়, যে জীবন নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তাঁরা কথা বলছেন জীবনের বিশেষ ধরন, বৈশিষ্ট্য বা মান নিয়ে। আলোচনার প্রসঙ্গ হচ্ছে মানুষের জীবনের ‘পরম ইষ্টি’ কী ? পরম ইষ্ট বা পরম ভালো ? মানুষের জীবনের পরামার্থিক মূল্য কিসে ?

ইটালির দার্শনিক গিওর্গিও আগামবেন গ্রিক শব্দের ব্যুৎপত্তি দিক বিচার করে বলছেন, প্রাকৃতিক জীবন বা জীবের জীবন নিয়ে প্লেটো বা এরিস্টটল কথা বলছেন না। জীবনের যে প্রকার বা ধরন নিয়ে তাঁরা কথা বলছেন সেখানে জীবনের জীবন- যে জীবন প্রাণী হিসেবে মানুষও যাপন করে- সেই জীবন একদমই তাঁদের বিষয় নয়। বরং কথা বলছেন জীবনের বিশেষ ধরন নিয়ে। জীবনের এই বিশেষ ধরনের ‘পরম ইষ্ট’ কোথায় পরিণতি লাভ করবে তার উত্তর দিতে গিয়ে এরিস্টটল তাঁর পলিটিক্স বইতে বলছেন :

‘জীবন সাধারণভাবে সকল মানুষ এবং প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রে আলাদা আলাদাভাবে [পরম ইষ্টর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ] এই জীবনের সর্বোত্তম পরিণতি। কিন্তু মানুষ আবার সংঘবদ্ধও হয় এবং জীবনের সহজভাবে বেঁচে থাকা বিবেচনা করে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীর চরিত্রও বহাল রাখে। এর কারণ সম্ভবত এই যে শুধু জীবনযাপনের মধ্যেই এক ধরনের ইষ্ট আছে। জীবনযাপনের ধরনে যদি কোনো বড় ধরনের বিপর্যয় না ঘটে তবে এটা পরিষ্কার যে অধিকাংশ মানুষ জীবনের অনেক দুঃখকষ্ট সহ্য করেই জীবন ধারণ করবে, যেন জীবনের মধ্যেই এক ধরনের প্রশান্তি ও স্বাভাবিক মিষ্টময়তা বিরাজ করে।’

জীবের জীবন বা যে জীবন প্রকৃতি বা প্রাকৃতিতার অধিক কিছু নয় সেই সরল প্রাকৃতিক জীবন আর জীবন বলতে ওপরে বা বোঝানো হয়েছে দুইয়ের মধ্যে তফাত আছে। গ্রিক চিন্তার মধ্যে নগর-রাষ্ট্রের যে ধারণা সেখানে এই প্রাকৃতিক জীবন বা প্রাণ একদমই অন্তর্ভুক্ত নয়। জীবনের পরম ইষ্ট নগর রাষ্ট্রে যে পরম পরিণতি লাভ করে সেই জীবন আর প্রাকৃতিক জীবনের ধারণার মধ্যে এই গোড়ার পার্থক্য বজায় রেখেই গ্রিক নগর রাষ্ট্রের ধারণা এবং সেই ধারণা আত্মস্থ করে আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণা গড়ে উঠেছে। এই পার্থক্য কঠোরভাবেই মানা হতো, কারণ চড়ষরং যদি রাজনৈতিকতার পরিমণ্ডল হয় তাহলে তার বিপরীতে প্রাকৃতিক জীবন বা প্রাণের পরিমণ্ডল ছিল ঙরশড়ং বা গৃহ। এরিস্টটল রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সম্পত্তি প্রধান আর পরিবার প্রধানের মধ্যে পার্থক্য টেনেছিলেন এবং যারা এই দুইয়ের পার্থক্যকে নিছকই পরিমাণগত মনে করত, গুণগত নয়, তাদের তিরস্কার করেছেন। অর্থাৎ ঘর যেহেতু আহার, বাসস্থান ও সন্তান উৎপাদন ও প্রতিপালনের তার সঙ্গে রাজনীতির ক্ষেত্র গুণগতভাবে আলাদা। এই দুই ক্ষেত্রে জীবন বলতে আমরা যা বুঝি তার অর্থও আলাদা। পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের যে জৈবিকতা আর রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে তার যে রাজনৈতিক অচ্চিত্ব দুইয়ের পার্থক্য বজায় রেখেই আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণা গড়ে উঠেছে। এরিস্টটল জীবের জীবনের সঙ্গে রাজনৈতিক জীবনের গুণগত পার্থক্য এত পরিচ্ছন্নভাবে এঁকেছেন যে জীবের জীবন নিয়ে বেঁচে থাকা আর রাজনৈতিক অচ্চিত্বের পার্থক্য হচ্ছে মানুষ ‘জীবন নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে কিন্তু অচ্চিত্ব যাপন করে আসলে পরম ইষ্টে’। পরম ইষ্টে অচ্চিত্ব যাপনের পরম পরিণতি নগর-রাষ্ট্র। এটি এরিস্টটলের পলিটিক্স গ্রন্থের একটি প্রখ্যাত উক্তি।

একই গ্রন্থে তাঁর বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে মানুষ রাজনৈতিক জীব। মানুষ জীব নয়, জীবের সঙ্গে তার পার্থক্যের জায়গা হচ্ছে জীব রাজনৈতিক নয়, কিন্তু মানুষ রাজনৈতিক। জীবের জীবন তার মনুষ্যত্বের সত্য নয়, তার সত্য রাজনৈতিকতায়। প্রজাতি হিসেবে জীবের সঙ্গে তার পার্থক্যের জায়গাও এখানে। মানুষের এই পার্থক্য নির্ণয়ের পরেই কেবল তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে মানুষের রাজনীতি গঠিত হয় রাজনৈতিকতার আরেকটি গুণ দিয়ে, সেটা হচ্ছে ভাষা। মানুষ ভাষাসম্পন্ন প্রাণী। অতএব জীবের মতো শুধু জীবের আরাম ও বেদনার মধ্যে মানুষের জীবন সংকীর্ণ নয় বরং ভাষার মধ্যে গড়ে ওঠে ‘ভালো’ ও ‘মন্দ’ সংক্রান্ত ধারণা এবং ‘অন্যায়’ ও ‘ইনসাফ’ ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে মানুষের রাজনৈতিক জগৎ বা রাজনৈতিক পরিমণ্ডল গড়ে ওঠে। জীবের জীবনের সঙ্গে মানুষের জীবনের পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।

ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো এরিস্টটলের এই জায়গা থেকেই শুরু করে তাঁর ‘ইন্দ্রিয়পরায়ণতার ইতিহাস’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন কীভাবে জীবের জীবন বাদ দিয়ে রাষ্ট্রের ধারণা গড়ে ওঠার পর আধুনিক রাষ্ট্রে মানুষের জৈবিক জীবন রাষ্ট্রের গোচরে আনা শুরু হয়। রাষ্ট্র ভূখণ্ডকেন্দ্রিক রাষ্ট্রের ধারণা জনগণকেন্দ্রিক ধারণায় রূপান্তরিত হতে শুরু করে, জনসংখ্যা, জনগণের স্বাস্থ্য ইত্যাদি রাষ্ট্রের বিষয়ে পরিণত হতে আরম্ভ করে। রাষ্ট্র ক্ষমতার কারিগরি বা কায়কারবারের মধ্যে মানুষের শরীর ও জৈবিক অস্তিত্ব নতুন হিসেবে নিকাশের অন্তর্ভুক্ত হয়। রাজনীতি, মিশেল ফুকোর ভাষায় জীব (শাসন) নীতিতে পরিণত হয়। ফুকো বলছেন, ‘হাজার বছর ধরে এরিস্টটলের কাছে মানুষ রাজনৈতিক অচ্চিত্ব যাপনের বাড়তি ক্ষমতাসম্পন্ন জীবন্ত জন্তু হয়েই ছিল; আধুনিক মানুষ হচ্ছে এমন জীব যার রাজনৈতিক অচ্চিত্ব তার জীব হিসেবে অচ্চিত্বযাপনকেই প্রশ্নবোধক করে তুলেছে।’

ফুকো চাইছিলেন রাষ্ট্র সংক্রান্ত চিন্তাভাবনা তাঁর সময় অবধি যেখানে প্রধানত আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক চরিত্রের বিচারে পর্যবসিত হয়ে গিয়েছিল সেখান থেকে রাষ্ট্র সরাসরি কীভাবে আমাদের শরীর ও জীবনযাপনকে নিয়ন্ত্রণ করে সেই বাচ্চব কারিগরির দিকে যেন আমরা নজর দেই। কোনো আগাম অনুমান ছাড়া। রাষ্ট্র আমাদের চিন্তা ও শরীর কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে সেই টেকনিকগুলো জানা রাষ্ট্র বোঝার জন্য জরুরি সন্দেহ নেই। রাষ্ট্র সংক্রান্ত ধারণার আইনি মডেল, যেমন, রাষ্ট্র ক্ষমতার বৈধতা তৈরি হয় কিসে, কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক বিচার, যেমন, রাষ্ট্র কাকে বলে- ফুকো এই মডেলগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছেন, যাতে রাষ্ট্র মানুষের মন ও শরীর উভয়কে আসলেই কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করে তার কলাকৌশল তিনি সরাসরি বর্ণনা করতে পারেন। রাষ্ট্রের আলোচনায় সার্বভৌমত্ব সংক্রান্ত আলোচনার প্রাধান্য থেকে বেরিয়ে আসাও তাঁর তাগিদ ছিল যাতে আসলে বাচ্চবে রাষ্ট্র কীভাবে কাজ করে সেই দিকটা মূর্ত বাচ্চব প্রক্রিয়া হিসেবে তিনি ধরতে পারেন। অর্থাৎ রাষ্ট্র সংক্রান্ত আলোচনার প্রচলিত ধারা থেকে বেরিয়ে এসে তিনি জীব (শাসন) নীতির কারিগরি প্রত্যক্ষ করে নতুন একটি মডেল খাড়া করতে পারেন।

আগামবেন ফুকোর অবদানকে স্বীকার করেন, অবশ্যই। কিন্তু তিনি দেখিয়েছেন ফুকোর অবদান স্বীকার করে নিলেও সমস্যা থেকে যায়। আইনি-প্রাতিষ্ঠানিক আর জীবশাসননীতি এই দুইভাবে রাষ্ট্রকে বিচারের মধ্যে সম্পর্কটা তাহলে কী ? রাষ্ট্র বিচারের এই দুই পদ্ধতিকে কোনোভাবেই আলাদা করা যাবে না, তাদের আসলে একই সমস্যা মোকাবিলার দিক থেকে দেখতে হবে। রাষ্ট্র আগে জীবের জীবনকে তার ধারণার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেনি, আধুনিক রাষ্ট্রের একটা পর্যায়ে এসে জীবের জীবন রাষ্ট্রের বিষয় হয়ে উঠছে। কিন্তু এটা তো হতে পারে রাষ্ট্র শুরুতেই জীবের জীবনকে বাদ দিয়ে রাজনৈতিকতার যে পরিমণ্ডলকে চিন্তা করেছিল সেখানেই রয়ে গেছে মুশকিল। সেটা রয়ে গেছে সার্বভৌমত্বের ধারণার মধ্যেই। জীবের জীবন যদি শুরুতেই রাজনীতির বাইরে থেকে যায়, অথচ যে মানুষ রাজনৈতিক সে একই সঙ্গে জীবও বটে- তাহলে এই জীবন রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ধারণা থেকে অদৃশ্য ছিল, কিন্তু বিযুক্ত ছিল না। আধুনিক সময়ে সেই জীবের জীবনই এখন দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। আগামবেন সেই দিকটাই আমাদের দেখিয়েছেন।

তাঁর বিখ্যাত বই ঐড়সব ঝধপবৎ-এ তিনি বলছেন গ্রিক সময় থেকেই মানুষের জীবের জীবন বাদ দিয়ে তাকে ‘রাজনৈতিক প্রাণী’ হিসেবে রাষ্ট্র ধারণার গোড়ায় প্রতিস্থাপন করা হয়েছে৪ এবং নগর, রাজনীতি, ক্ষমতা ইত্যাদি সেই প্রতিস্থাপনের প্রকাশ হিসেবে আমরা দেখে আসছি সেখানেই রয়ে গেছে মুশকিল। রাজনৈতিক জীবনের দিক থেকে দেখলে মানুষের জীবের জীবন হচ্ছে ন্যাংটা অর্থাৎ প্রতিরক্ষাহীন, আগামবেনের ভাষায় নধৎব ষরভব বা শুধুই প্রাণ। জীব। রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের দিক থেকে একমাত্র তার রাজনৈতিকতাই (যেমন, তার ব্যক্তি অধিকারে) রাষ্ট্র স্বীকার করে বটে কিন্তু ততটুকুই যতটুকু মানুষের রাজনৈতিক সত্তা রাষ্ট্র মেনে নেয়। জীবনের কতটুকু রাজনীতিকরণ করা গেল সেটা সংবিধানের মৌলিক মানবিক অধিকার অংশে আমরা দেখতে পারি। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান বলছে, ‘আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না’ (অনুচ্ছেদ ৩২)। অর্থাৎ রাষ্ট্র অবশ্যই জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা থেকে ব্যক্তিকে বঞ্চিত করতে পারে, তবে রাষ্ট্রের দায় শুধু অতটুকুই যে সেটা আইন অনুযায়ী করতে হবে। তাছাড়া বাংলাদেশের সংবিধানে মৌলিক অধিকার যাই থাকুক রাষ্ট্র ১৪২ ধারা অনুযায়ী যা খুশি আইন করতে পারে। এবং মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ প্রসঙ্গে এ কথাও পরিষ্কার বলা আছে যে, ‘সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের অধীন প্রণীত সংশোধনের ক্ষেত্রে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই প্রযোজ্য হইবে না’। ‘(২৬ (৩)। তাহলে আগামবেন যাকে ’নধৎব ষরভব’ বা ন্যাংটা বা খোলা জীবন বলছেন তার মানে দাঁড়াচ্ছে এই যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কাছে বা তথাকথিত রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের কাছে নাগরিকরা ‘পবিত্র’, কিন্তু এই অর্থে পবিত্র ও যে রাষ্ট্র এই জীবনকে উৎসর্গ করে দিতে পারে না, অথচ রাষ্ট্রের কাছে এই জীব-জীবনের কোনোই রাজনৈতিক তাৎপর্য নেই।

রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ধারণার সঙ্গে আগামবেনের জীবের জীবন ও রাজনৈতিক জীবনের সম্পর্ক বিচারের প্রসঙ্গ সরাসরি জড়িত। আগামবেন বলছেন সার্বভৌম ক্ষমতার পরিমণ্ডল পবিত্র মানুষের প্রতীকী ধারণার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই অর্থে যে জীবের জীবনকে রাষ্ট্র বাদ দিতে পারে না বা উৎসর্গ করতেও পারছে না, কিন্তু জীবন এই নিষেধাজ্ঞার অধীনে যেখানে বাঁধা পড়ে গেল সেখানে তাকে হত্যা করা চলে। যে জীবনকে বাদ বা উৎসর্গ করা যায় না কিন্তু হত্যা করা যায়- আধুনিক রাষ্ট্র ও সার্বভৌমত্ব মানুষের জীবের জীবনকে এইভাবে নগ্ন বা খোলা জীবনে পর্যবসিত করেই সার্বভৌম হয়ে ওঠে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ধারণা একই সঙ্গে নগ্ন ও খোলা জীবনকেও তৈরি করে, যাকে রাষ্ট্রে হত্যা করতে পারে। আগামবেন বলছেন,

‘যদি তাই হয় জীবন ও ভালো জীবনের বিরোধিতার জায়গায় দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের যে সংজ্ঞা এরিস্টটল দিয়েছেন। তার অর্থ আমাদের এখন পুনর্বিবেচনা করতে হবে। এই বিরোধিতা আসলে একই সঙ্গে দ্বিতীয়ের মধ্যে প্রথমটির অর্থ বিজড়িত করা, রাজনৈতিকভাবে গুণান্বিত জীবনের মধ্যে ন্যাংটা জীবনের প্রক্ষেপ। এরিস্টটলীয় সংজ্ঞার ক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি আমাদের করা বাকি সেটা শুধু ‘ভালো জীবন’ কথাটার মানে, তার ধরন বা তার পরিণতির গতি কীভাবে রাজনৈতিকতা হয়ে ওঠে সেখানে নয়, যদিও এটাই এতকাল অনুমান করে রাখা হয়েছে। আমাদের বরং প্রশ্ন করতে হবে কেন পাশ্চাত্যের রাজনীতির পরিগঠন ন্যাংটা জীবনকে বাদ রেখেই নিজেকে আগে পরিগঠন করে (এই পরিহার একই সঙ্গে অন্তর্ভুক্তিও বটে) প্রশ্ন করতে হবে রাজনীতি ও জীবনের সম্পর্ক কী ? যদি জীবন নিজেকে এমন হাজির রাখে যে তাকে বাদ রেখেই তার অন্তর্ভুক্তি ঘটে থাকে? (আগামবেন ১৯৯৫; পৃ-৭)

এই কালের রাজনীতির দিক থেকে এই প্রশ্ন নতুনভাবে উঠছে। রাষ্ট্র ও জীবনের সম্পর্ক কী ? জীবের জীবনের জায়গা থেকে রাষ্ট্রের বিচার অতি আবশ্যিক বিপ্লবী কর্তব্য হয়ে উঠেছে।
ফরহাদ মজহার

No comments:

Post a Comment