Monday, 6 April 2009

মন না বদলালে দিন বদলাবে না

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে কোনো বিষয়ে সমঝোতা বা ঐক্য হতে পারে, এ প্রায় অকল্পনীয়। কেউ কেউ বলেন, দা-কুমড়ো সম্পর্ক দল দুটোর মধ্যে। দেশের অন্য যেকোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এ দুটো দলের যেকোনোটির ঐক্য হতে পারে, জোট হতে পারে। কিন্তু এই প্রধান দুটি দলের ঐক্যতো দূরের কথা, কোনো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ঐকমত্যে পৌঁছানোও অসম্ভব। এ যেমন সত্য কেন্দ্রীয় পর্যায়ে, তেমনই তৃণমূল স্তরেও। বিএনপি উত্তরে গেলে আওয়ামী লীগ যাবে দক্ষিণে। যেতেই হবে। তা না হলে দল দুটোর রাজনীতি থাকে না। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো এমন কিছু কিছু ব্যাপার আছে, যেখানে সব বিভেদ ভুলে দুটি দলই পরস্পর সহযোগী হয়ে যায়।

ঠিক এরকমই একটি খবর বেরিয়েছে গত শনিবার পত্রিকান্তরে। প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয় পুরোনো ঢাকায় চাঁদাবাজির প্রশ্নে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি চমৎকার সমঝোতা করে নিয়েছে। আওয়ামী লীগের চাঁদাবাজদের হয়ে বিএনপির একশ্রেণীর মুখচেনা মাস্তান কাজ করে দিচ্ছে খোশমেজাজে। পাড়ামহল্লার ছোট ছোট দোকানদার-ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা তোলার কাজটা করছে তারাই। চাঁদাবাজির বেলায় তাদের কোনো বিরোধ নেই। এ ব্যাপারে পিলে চমকানো খবর আছে আরও। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র সাত দিনের মাথায় শোনা যায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা বিএনপি পন্থী সন্ত্রাসীদের সঙ্গে বৈঠক করেন নির্বিঘেœ চাঁদা তোলার বিষয়ে একমত হওয়ার জন্য এবং রফা করে নেন এ বিষয়ে। সে অনুযায়ী লালবাগে দেদারসে চলছে চাঁদাবাজি। এলাকাবাসির বিবেকবান লোকেরা বলছেন, ছাত্র এবং যুব নেতারা চাঁদাবাজির সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

এই সংবাদে মনে পড়ে গেলো কবি আবুল হোসেনের একটি কবিতার দুটো লাইন। লাইন দু’টি হচ্ছে: ‘লুটের বেলায় নেই বিভেদ, কেতাব কিংবা পড় ুক বেদ’। বাস্তবিকপক্ষেই যে বা যারা স্বভাবগতভাবে লুটেরা তাদের অবস্থান যেখানেই হোক না কেন কাজে কোনো পার্থক্য নেই। আদর্শের কথাটা তাদের ছদ্মবেশ। সেটা হতে পরে ধর্মীয় কিংবা হতে পারে রাজনৈতিক আদর্শ; লুটপাট করতে এই শ্রেণীর লোকদের বাধে না। এদের বাইরের পোশাক ও সাইনবোর্ডের ব্যবধান থাকলেও তলে-তলে এরা মাসতুতো ভাই। পরস্পর সহযোগী। সব রসুনের গোড়া একটি। প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী লালবাগের পরিস্থিতি তারই একটি ছোট উদাহরণ। খুঁজলে এবং তলিয়ে দেখলে এ ধরনের ছোটবড় আরও অনেক দৃষ্টান্ত যে বের করা যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

একটা কথা ঠিক যে, ক্রিমিনালদের কোনো জাত নেই, নেই দল। এদের কোনো রাজনৈতিক আদর্শও থাকার কথা নয়। থাকতে পারে না। লুটপাট এবং অপরাধকর্ম নির্বিঘেœ চালিয়ে যাবার প্রয়োজনে এরা যেকোনো অবস্থান ও ছদ্মবেশ ধারণ করতে পারে। যেকোনো রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় থাকতে পারে। এদের কোনো দল নেই, রাজনীতি নেই। কিন্তু, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমাদের রাজনৈতিক নেতারা প্রায়শই এ বিষয়টি বুঝেন না অথবা বুঝতে চান না। তারা নিশ্চয়ই নিজেদের খুব বেশী বুদ্ধিমান মনে করেন, কৌশলী হিসাবে বিবেচনা করেন। তারা হয়তো ভাবেন যে, মাস্তান ক্রিমিনালদের তারা (নেতারা) ব্যবহার করছেন। কিন্তু, কার্যত দুষ্কৃতকারীরাই যে দলের প্ল্যাটফর্মটাকে ব্যবহার করে থাকে- নেতারা সেটা বুঝেও না বোঝার ভান করেন। ফলে আমাদের দেশের রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দলের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভাইরাসের মত সক্রিয় রয়েছে মাস্তান-চাঁদাবাজরা। রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থা এমন হয়ে গেছে যে, দুর্বৃত্ত-দুষ্কৃতকারীদের ছাড়া যেন চলেই না। দুর্নীতির রাজনীতির এমন পরিণতিই স্বাভাবিক।

মাঝে মাঝে মনে হয়, আমাদের দেশে কোনো কোনো দলের এবং নেতার অবস্থা হয়ে গেছে তামাকসেবী লোকের মত। সিগারেট বা তামাকসেবী যারা, তারা বুঝেন এবং জানেন যে, এই ধোঁয়া বিষাক্ত, স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। নিকোটিন সৌন্দর্য, সুস্থতা এবং জীবনীশক্তি শুষে নেয়। তারপরও ধূমপান সহজে ছাড়তে পারে না। রক্তে মিশে থাকা নিকোটিন তাকে বারবার সিগারেটের দিকে নিয়ে যায়। সিগারেটের কটু গন্ধ তাকে প্রতি মুহূর্তে টানে প্রবলভাবে। এই সর্বনাশা টান রক্তে মিশে থাকা নিকোটিনের। একইভাবে রাজনৈতিক দলগুলো, দলের কোনো কোনো নেতা-পাতি নেতা নিকোটিন সদৃশ দুষ্ট ভাইরাসের টান যেন উপেক্ষা করতে পারেন না। তারা মুখে বলেন গণতন্ত্রের কথা, মানুষের অধিকারের কথা, দেশপ্রেমের কথা, আর কাজের বেলায় উল্টো করেন। মাস্তান-চাঁদাবাজদের পোষেন, লালন করেন, পালন করেন। এদের ছাড়া যেন তাদের চলে না কিছুতেই। আর নেতাদের আশ্রয়ে থেকে তারা রাজনীতিকে কলুষিত করে যাচ্ছে দিনের পর দিন।

দু’ বছর আগে, ওয়ান ইলেভেনের মধ্যদিয়ে গোটা জাতি উপলব্ধি করতে পেরেছিলো যে, এদেশের রাজনীতি নিজেই নিজের শত্রু হয়ে গেছে। দলগুলো রুগ্ন-কলুষিত। রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি দলগুলোর অন্তরের শক্তি বিনাশ করে দিয়েছে বহুলাংশে। সেই প্রেক্ষাপটেই সর্বমহলে দাবি ওঠে রাজনৈতিক দলের সংস্কার-সংশোধনের। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে যারা এই দাবি নিয়ে সরব হয়েছিলেন, তাদের সবাই যে আন্তরিক ছিলেন, তা হয়তো নয়। কেউ কেউ হয়তো বাড়াবাড়িও করেছেন। কিন্তু, একথা অনস্বীকার্য যে, সাধারণ মানুষ মনেপ্রাণে চেয়েছেন রাজনৈতিক সংস্কৃতির শুভ পরিবর্তন। কোনো রাজনৈতিক দলে মাস্তান-দুর্বৃত্তদের স্থান হবে না, এমনটিই তারা প্রত্যাশা করেছিলেন। সচেতন নাগরিকমাত্রই চাইছিলেন যে, শিক্ষাঙ্গনে কোনো রাজনৈতিক দলের অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠনের উৎপাত থাকবে না। ছেলেমেয়েরা নির্বিঘেœ নির্ভয়ে লেখাপড়া করবে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্র অঙ্গনে হানাহানি হবে না, ক্যাম্পাসের সবুজ ঘাস রক্তে ভিজবে না, অস্ত্রের ঝনঝনানি থাকবে না। পাড়ায়-মহল্লায় ব্যবসা কেন্দ্রে চাঁদাবাজ-মাস্তানদের উৎপাত থাকবে না।

রাজনৈতিক সংস্কৃতির সেই বাঞ্ছিত পরিবর্তনের জন্যেই দাবি উঠেছিলো রাজনৈতিক দলের অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন না রাখার। গণপ্রত্যাশার আলোকে ইলেকশন কমিশনে দল নিবন্ধনের বেলায় অঙ্গ সংগঠন না রাখার শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু সে কথা শোনেনি দলগুলো। তারা বি-টিম হিসেবে সহযোগী সংগঠন রেখেছেন এবং তাদের জন্য দলের ভাবমূর্তি রক্ষা কঠিন হয়ে পড়েছে।

কিন্তু, বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনের ধারায় আওয়ামী লীগ এখন পর্যন্ত খুব বেশি অগ্রসর হতে পারেনি। রাজনৈতিক দলীয় ছাত্র সংগঠনগুলো সক্রিয় হয়ে উঠেছে আগের মত। ক্যাম্পাসে রক্তপাত, সংঘাত, হানাহানি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগ দেশের সর্বত্র বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। হল দখল এবং প্রতিপক্ষ দমনের নামে চলছে নিত্যহানাহানি। গত শুক্রবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে আবারও সংঘর্ষ হয়েছে। আহত হয়েছে কমপক্ষে দশজন। এর আগে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার অল্পকালের মধ্যে একাধিকবার এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষ হয়েছে। ছাত্রলীগ ও ছাত্র শিবিরের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে রাজশাহীর প্রায় সবগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করতে হয়েছে। এইতো কয়েকদিন আগে বন্ধ হলো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ।

ছাত্র রাজনীতি, ছাত্র সংগঠন নিয়ে আমরা ইতিপূর্বে অনেক লিখেছি। একথা কে অস্বীকার করবে যে, আমাদের ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে, প্রতিটি সংকট-সন্ধিকালে ছাত্রসমাজ তারুণ্যের শক্তি নিয়ে পালন করেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। ছাত্রদের সংগঠিত করতে, জাতির বৃহত্তর প্রয়োজনে এই যুবজনতার শক্তিকে উদ্বুদ্ধ করতে ছাত্র সংগঠনগুলো, বিশেষ করে ছাত্রলীগ পালন করেছে এক অনন্য ভূমিকা। কিন্তু সেই ছাত্রলীগ কিংবা অতীতের যেকোনো ছাত্র সংগঠনের আদর্শ এবং বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে এখনকার ছাত্র রাজনীতির কোনো মিল নেই। পাকিস্তান আমলে ছাত্রলীগ ছিলো আওয়ামী লীগের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। আর এখন এই সংগঠনটি সত্যি বলতে কি দলের জন্য বিরাট বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছাত্রলীগের কর্মী-ক্যাডাররা মূল দলের নেতাদের ব্যক্তিগত স্বার্থের ক্রীড়নক হিসাবে প্রয়োজনীয় হতে পারে, কিন্তু দলের জন্য এরা অপরিহার্য নয়।

পাকিস্তান আমলে আওয়ামী লীগ যে কথা বলতে দ্বিধা করতো তা বলতো ছাত্রলীগ। প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। তখন ছাত্রলীগ অপরিহার্য হলেও এখন সে পরিস্থিতি নেই। এই ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের জন্য অপরিহার্য নয়। তবুও কেন যে আওয়ামী লীগ ছাত্র সংগঠনের ব্যাপারে নির্মোহ হতে পারছে না তা বোধগম্য নয়। ছাত্রলীগের নামে ক্যাম্পাসে রক্তপাত হবে, মাস্তানি-চাঁদাবাজি চলবে, দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে- তারপরেও আওয়ামী লীগ নির্বিকার থাকবে কেন, এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। সংঘাত-সংঘর্ষের পর কমিটি ভেঙ্গে দেয়া বা কার্যক্রম সাময়িক স্থগিত করে যে কোনো ফলোদয় হয় না, তাও ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়ে গেছে। কাজেই ছাত্রলীগের প্রশ্নে আওয়ামী লীগের কঠোর অবস্থান নেয়ার সময় এসেছে। এই ছাত্র সংগঠনের সাথে আওয়ামী লীগ সম্পর্ক ছিন্ন করলে আদৌ কোনো ক্ষতি হবে কিনা, তা ভেবে দেখা উচিত এবং সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া বাঞ্ছনীয়।

বলছিলাম রাজনৈতিক দলের গুণগত পরিবর্তনের কথা। আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায়। ক্ষমতাসীনদেরই স্থাপন করতে হয় ভাল দৃষ্টান্ত, যাতে অন্যেরা তা অনুসরণ করতে পারে। আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের দৃষ্টিভঙ্গি যতক্ষণ না বদলাবে ততক্ষণ ভাল কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপিত হতে পারে না। মন না বদলালে দিন বদলাবে না। দিন বদলাতে দলকে পরিশুদ্ধ করতে হবে। দলের ভেতরে দুর্বৃত্ত, চাঁদাবাজ, মাস্তান যারা আছে তাদেরকে চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে দলের ভেতরে শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে। পার্টির ভেতরে দুর্র্বৃত্ত-অপরাধীদের রেখে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনা যাবে না। দিনবদলের শ্লোগান শ্লোগানই থেকে যাবে। জনজীবনে পরিবর্তনের কোন হাওয়া বইবে না। (সংগৃহীত)

No comments:

Post a Comment