Sunday, 5 April 2009

পথহারা ছাত্র রাজনীতি

০ শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা থামছে না

০ ছাত্রনেতারা অপকর্মে সম্পৃক্ত

০ গোয়েন্দা রিপোর্টে চাঞ্চল্যকর তথ্য

।। আবুল খায়ের ও সাইদুর রহমান ।।

ছাত্র রাজনীতি তার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস হারাতে বসেছে। অতীতের ঐতিহ্য আর আদর্শকে ম্লান করে ছাত্র রাজনীতি দলীয় লেজুড়বৃত্তিতে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এসব কারণে শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা থামছে না। অশান্ত হয়ে উঠেছে ক্যাম্পাসগুলো। বর্তমানে অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। নোংরা রাজনীতির জন্য হল ও ক্যাম্পাস ছাড়া হয়েছে অসংখ্য শিক্ষার্থী। অবস্থা বেগতিক দেখে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংঘাত-সন্ত্রাসই নয়, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ভর্তি বাণিজ্যসহ শহর ও পল্লী অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে ছাত্র নেতারা নানা অপকর্মেও জড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু এত কিছুর পরেও ছাত্র-রাজনীতির লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। বর্তমানে শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রলীগের সংঘর্ষে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড বিব্রত। এসব সংঘর্ষের ঘটনায় গোয়েন্দা রিপোর্টে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এদিকে সাম্প্রতিককালে ছাত্রলীগের ঘটনাবলী নিয়ে গতকাল শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ধানমণ্ডির কার্যালয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্যদের বৈঠক শুরু হয়েছে। ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আওয়ামী লাীগের দলীয় মুখপাত্র সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, যারা দুর্নীতি ও সংঘর্ষের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ছাত্রলীগের ঘটনা নিয়ে দল উদ্বিগ্ন।

১৯৯০ সালের পর থেকে ছাত্র-রাজনীতিতে এক ধরনের দুর্বৃত্তায়ন শুরু হয়। এ জন্য ২ দশকের বিভিন্ন সময়ে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনেক শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন হুমকির মুখে পড়েছে। বিশেষ করে বিগত সময়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের আগ্রাসনমূলক আচরণের কারণে ধ্বংস হয়েছে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রম। ছাত্র-সংগঠনের সংঘর্ষে অনেক ছাত্রকে অকালে প্রাণ দিতে হয়েছে। বর্তমানে শুধু ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের কার্যক্রম নয়, বিগত সরকারের আমলেও ছাত্রদল ও শিবির শিক্ষাঙ্গনে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালায়। ছাত্র রাজনীতির নামে বর্তমানে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাস, ভর্তি বাণিজ্যসহ শহর ও পল্লী অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে ছাত্র নেতারা নানা অপকর্মেও জড়িয়ে পড়েছে। ছাত্র রাজনীতি পুঁজি করে অনেকে কোটিপতি বনে গেছেন। ছাত্র নেতাদের সার্বিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক বলেছেন, ছাত্র নেতারা একজন মন্ত্রী বা এমপি’র চেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকে বিভিন্ন তদবির নিয়ে। তারা ছাত্রদের অধিকার নিয়ে এখন আর রাজনীতি করে না। তারা নিজেদের জন্য রাজনীতি করে। তিনি আরো বলেন, বর্তমান ছাত্র নেতারা দামি-গাড়িতে চড়ে মধুর ক্যান্টিনে রাজনীতি করতে আসে।

ছাত্র রাজনীতির নামে শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্য

বর্তমানে ছাত্রলীগের নোংরা রাজনীতির কারণে শিক্ষাঙ্গনে এক ধরনের নৈরাজ্য বিরাজ করছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা থামছে না। থেমে থেমে সংঘর্ষ চলছে। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে সংঘর্ষ হয়েছে। এই সংঘর্ষের কারণে অনেক শিক্ষার্থী ক্যাম্পাস ছাড়া হয়েছে। একাধিক ছাত্রকে প্রাণ দিতে হয়েছে। এ জন্য ছাত্র রাজনীতির ধরন ও আদর্শ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বলা হচ্ছে, শিক্ষাঙ্গনে নোংরা রাজনীতির চর্চা হচ্ছে। নোংরা ছাত্র রাজনীতির নামে গত ১৪ জানুয়ারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত হয় একটি গ্রুপ। বিতাড়িত গ্রুপের প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন এখন হুমকির মুখোমুখি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৪ জানুয়ারি নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের জের ধরে ১৮ জানুয়ারি সেখানকার ছাত্রলীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ তাদের পছন্দের ভিসি নিয়োগের দাবিতে ১৭ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাণ্ডব চালায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৩ মার্চ শিবিরের সাধারণ সম্পাদক নিহত হওয়ার জের ধরে বন্ধ হয়ে যায় শহরের সব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সংঘাত এড়াতে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ, রাজশাহী সরকারি কলেজ, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী নিউ সরকারি ডিগ্রি কলেজ, রাজশাহী সিটি কলেজ, রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, রাজশাহী ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ও। বন্ধ রয়েছে ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ। গত ৩১ মার্চ গভীর রাতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ডা. ফজলে রাব্বি হলে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে নিহত হয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আসাদ রাজীব। পরের দিন দুপুরে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রাজধানীর ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে উভয় গ্রুপের কমপক্ষে অর্ধ শতাধিক ছাত্র আহত হয়। অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের কারণে খুলনা বিএল কলেজ, সিলেট পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তবে ইতিমধ্যে তা খুলে দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার পর উত্তেজনা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় চট্টগ্রাম ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসন ১ মাসের জন্য ছাত্র সংগঠনের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায়ই ছাত্রদল নেতা-কর্মীরা ছাত্রলীগের হামলার শিকার হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদল লাগাতার ধর্মঘট ডেকে ক্যাম্পাস অচল করে দেয়ার হুমকি দিয়েছে। গত শুক্রবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপ সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এ ঘটনায় ১০ জন আহত হয়েছে। পুলিশ হলে তল্লাশী চালিয়ে ৫ জনকে আটক করে। সর্বশেষ গতকাল শনিবার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। এতে কমপক্ষে ১০ জন আহত হয়েছে। বর্তমানে এই ক্যাম্পাসে উত্তেজনা বিরাজ করছে, যে কোন সময়ে আবার সংঘর্ষ বাধতে পারে।

ছাত্র সংগঠনগুলোর ভর্তি বাণিজ্য

ছাত্র রাজনীতির নামে গত ১৯ বছর বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি বাণিজ্যে সম্পৃক্ত হয়েছে। হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। বর্তমান ও বিগত সময়ে মূলত ছাত্রলীগ, ছাত্রদল ও ছাত্র শিবির এসব কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল। সরকারের মদদপুষ্ট ছাত্র সংগঠন বিভিন্নভাবে এসব কাজে উৎসাহ পেয়েছে। শুধুমাত্র ছাত্রলীগ চলতি বছরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৮-০৯ সেশনের অনার্স ভর্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে অনিয়মের নজির সৃষ্টি করেছে। অভিযোগ রয়েছে, ভর্তিতে ছাত্রপ্রতি ৫০ হাজার টাকা এবং ভালো সাবজেক্টে মাইগ্রেশন করাতে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা নিয়েছে তারা। রাজধানীসহ দেশের সরকারি কলেজগুলোতে অবৈধভাবে ২০০৮-০৯ সেশনের অনার্স প্রথমবর্ষে ভর্তিতে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য করেছে ছাত্র নেতারা। এ কারণে রাজধানীর ইডেন, ঢাকা কলেজ, তিতুমীর, কবি নজরুল, বদরুন্নেসা, সোহরাওয়ার্দী ও মিরপুর বাঙলা কলেজেও মেধাবীরা ভর্তির সুযোগ পায়নি। অধ্যক্ষ ও ভর্তি কমিটির আহ্বায়ককে চাপ দিয়ে গাজীপুরের টঙ্গী কলেজ, ভাওয়াল বদরে আলম কলেজ, রাজশাহীর সিটি কলেজ, নিউ গভঃ ডিগ্রি কলেজ, রাজশাহী কলেজ, খুলনার বিএল কলেজ ও সরকারি আযম খান কমার্স কলেজ, চট্টগ্রামের সিটি কলেজ ও কমার্স কলেজ, কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজ এবং বরিশালের বিএম কলেজে নিজেদের পছন্দের ছাত্র ভর্তি করেছে ছাত্রলীগ নেতারা। ছাত্রলীগকে কোটা দিতে অস্বীকার করায় ভর্তি প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়ারও ঘটনা ঘটিয়েছে তারা। অনার্স প্রথমবর্ষে ভর্তিতে কোটা না দেয়ায় ছাত্রলীগ ঢাকা কলেজের ভর্তি প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়। আধিপত্য জাহির করতে তারা ক্যাম্পাসে ককটেল বিস্ফোরণ এবং মেধা তালিকায় ভর্তিচ্ছুদের মারধর করেছে। এ ছাড়া দেশের আরো বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিয়তই ঘটছে নানারকম সংঘর্ষের ঘটনা। এসব ভর্তি বাণিজ্যে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন তাদের বিরোধী ছাত্র সংগঠনকেও আর্থিক সহযোগিতা করেছে। মূলত আন্দোলন কর্মসূচি থেকে বিরত রাখার জন্য এ কাজ করা হচ্ছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।

আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড বিব্রত

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের সংঘর্ষ বর্তমান আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড ও মহাজোট সরকারের শীর্ষ মহলকে ভাবিয়ে তুলেছে। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেয়ার পরেও সংঘর্ষ চলছে। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে ক্যাডার হিসেবে খ্যাত গ্রুপটি আধিপত্য আর টাকার ভাগ-বাটোয়ারা ও দখলবাজি করতে গিয়ে খুনখারাবি করে যাচ্ছে। গত সোমবার রাতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফজলে রাব্বি ছাত্রাবাসে প্রতিপক্ষ গ্রুপ ছাত্রলীগের একাংশের সাধারণ সম্পাদক রাজিবকে তিনতলায় তার কক্ষের সামনের বারান্দায় নির্দয়ভাবে প্রহার করে। আত্মরক্ষার জন্য রাজিব তিনতলা থেকে নীচে লাফিয়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। ঘাতকরা নীচে গিয়ে রাজিবের মাথায় রড ও হকিস্টিক দিয়ে বেদম প্রহার করে মৃত্যু নিশ্চিত করে পালিয়ে যায়। সাম্প্রতিকালে জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্য অস্ত্র হাতে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়। পরে সরকারের শীর্ষ মহলের নির্দেশে ছাত্রলীগ ক্যাডার সুমনকে গ্রেফতার করা হয়। সর্বশেষ গতকাল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ হয়। এতে সরকার অনেকটা বিব্রত।

গোয়েন্দাদের চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ

ঢাকা ও ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহীসহ বিভিন্ন স্থানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংঘর্ষের পর একটি গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধানে প্রকাশ পায়, ছাত্রলীগের একশ্রেণীর নেতা চাঁদা আদায়, নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখা ও টেন্ডারবাজিসহ নানা অপরাধ থেকে নিয়মিত মাসোহারা আদায়ের জন্য ক্যাডার লালন-পালন করে। ছাত্র নয় এমন ক্যাডারের সংখ্যই বেশি। তারা টাকা পেলে খুনসহ যেকোন অপরাধ ঘটিয়ে থাকে। বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য বিভিন্ন ধরনের কাজ এই সকল ক্যাডার দ্বারা করানো হচ্ছে। একটি মহল ক্যাডারদের আর্থিক সুবিধা দিচ্ছে বলে গোয়েন্দা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। এই সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেছেন, বিষয়টির আরো গভীরে গিয়ে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ক্যাডাররা সব সময়ই যে সরকার ক্ষমতায় আসে সেই সরকারের দলীয় লোক সেজে যায়। তাদের বিরুদ্ধে হত্যা, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসসহ নানা অপরাধে মামলা থাকা সত্ত্বেও দলীয় সাইন বোর্ড থাকায় গ্রেফতারে পুলিশ তেমন কোন ভূমিকা পালন করেনি। তাদের গ্রেফতার করলে দলীয় নেতা-কর্মীরা থানা ঘেরাও করে কিংবা নানা ধরনের চাপ সৃষ্টি করে থাকে। এসব কারণে পুলিশ তাদের গ্রেফতারে নমনীয় মনোভাব প্রদর্শন করে থাকে বলে গোয়েন্দা সূত্রে বলা হয়। পুলিশের আইজি নূর মোহাম্মদ বলেছেন, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। অস্ত্রসহ জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাডারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশৃঙ্খলাকারী যেই হোক না কেন তাদের গ্রেফতার করা হবে।

ছাত্র সংগঠনগুলোর চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি

ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা শিক্ষাঙ্গনে সংঘর্ষ, ভর্তি বাণিজ্যের পাশাপাশি চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজিতে সম্পৃক্ত হয়। ছাত্রদলের পথ অনুসরণ করে ছাত্রলীগও এখন এসব কর্মকাণ্ড শুরু করেছে। ছাত্রলীগের চেইন অব কমান্ড শক্তিশালী না হওয়ায় তারা এবার সবচেয়ে বেশি বেপরোয়া হয়েছে। দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশে অবস্থিত মার্কেটসমূহ থেকে তারা প্রতিনিয়ত চাঁদাবাজি করছে। অভিযোগ রয়েছে, ছাত্রলীগ চাঁদাবাজির নামে ব্যবসায়ীদের ভয়-ভীতি দেখাচ্ছে। মিরপুর এলাকার এক ডিশ ব্যবসায়ী ইত্তেফাককে জানান, মিরপুর বাংলা কলেজের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তার কাছ থেকে প্রতিমাসে ১০ হাজার টাকা চাঁদা নিচ্ছে। চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে ব্যবসা বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দেয়। তাই বাধ্য হয়ে চাঁদা দিতে হচ্ছে। এছাড়াও ঢাকা, রাজশাহী, চট্ট্গ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথ, শাহজালালসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে নিয়মিত টেন্ডারবাজি করছে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এ বিষয়ে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তারা সবসময়ই অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছে।

তদবিরে এগিয়ে ছাত্র নেতারা

দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু হওয়ার পর থেকে ছাত্র নেতারা তদবিরে জড়িত হয়ে পড়ে। এর জের ধরে ছাত্র নেতারা কোটিপতি বনে যান। বর্তমান ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগও তদবিরের পথ অনুসরণ করেছে। ছাত্রলীগের নেতারা জানান, বিভিন্ন সরকারি চাকরির জন্য ইতিমধ্যে ছাত্রলীগ নেতারা তদবির শুরু করেছে। এ জন্য কোন্ পদে কতজন লোক নেয়া হবে তা বিবেচনা করে তালিকা করা হচ্ছে। এই তালিকায় মেধার পরিবর্তে রাজনৈতিক বিবেচনায় টাকার বিনিময়ে লোক নিয়োগ করা হবে। বিগত বিএনপি-জোট আমলে ছাত্রদলের অনেক নেতা তদবির করে কোটিপতি হয়েছে। বর্তমানের ছাত্র নেতারা সাংগঠনিক কাজের চেয়ে তদবিরকে উৎকৃষ্ট মনে করছে। তদবিরে সরকারের মন্ত্রীদের ছাত্র নেতারা ভুল বুঝিয়ে থাকে। দলীয় লোক নেয়ার কথা বলে মন্ত্রীর কাছ থেকে তারা কোটা নিয়ে ব্যবসা করে। গত কয়েক বছর যেসব চাকরি হয়েছে তার অধিকাংশ ছাত্র নেতাদের মাধ্যমে। এ জন্য তদবিরে সব সময় ছাত্র নেতারা এগিয়ে থাকেন।

রাজনৈতিক দলগুলোর উৎসাহ

ছাত্র সংগঠনগুলোকে লেজুড়বৃত্তির রাজনীতিতে টেনে আনার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়ী করা হয়ে থাকে। বিগত বিএনপি-জোট আমলে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে চা বাবদ তৎকালীন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব তারেক রহমান প্রতিমাসে দুই লক্ষ টাকা খরচ দিতেন। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারও তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে মধুর ক্যান্টিনের চা খরচ বাবদ মোটা অংকের টাকা দিচ্ছে। এসব খরচ দিয়ে প্রকারান্তরে রাজনৈতিক দলগুলো ছাত্র রাজনীতিকে কলুষিত করেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রত্যক্ষ আর্থিক সহযোগিতার কারণে ছাত্র সংগঠনগুলো বেপরোয়া হয়ে ওঠে।

ছাত্র রাজনীতি নিয়ে বিশিষ্টজনদের ভাবনা

শিক্ষাঙ্গনের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে দেশের বিশিষ্টজনরা বলেছেন, তরুণ প্রজন্মকে টিকিয়ে রাখার জন্য ছাত্র রাজনীতির আদর্শ ফিরিয়ে আনা জরুরি। ছাত্র রাজনীতিকে ছাত্রদের অধিকার আদায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করতে হবে। প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে ছাত্র-সংসদ চালু করতে হবে। তারা বলেন, কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েও শিক্ষার পাঠ না চুকিয়ে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে। এর একমাত্র কারণ ঐ সংঘর্ষের ছাত্র রাজনীতি। অথচ বাংলাদেশের অভ্যুদয় থেকে শুরু করে আমাদের ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন প্রভৃতি ক্ষেত্রে ছাত্র রাজনীতির ভূমিকা ছিল অপরিসীম। তখন দেশের সকল জাতীয় আন্দোলন সংগ্রামে ছাত্ররাই অগ্রণী ভূমিকা রাখত।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ছাত্র রাজনীতি বর্তমানে কলুষিত হয়ে পড়েছে। ছাত্ররা আদর্শ বিচ্যুত হয়ে জড়িয়ে পড়ছে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, আধিপত্য বিস্তারসহ নানা অপকর্মে, যা কখনো রাজনীতি হতে পারে না। তিনি বলেন, ছাত্র রাজনীতি মানে তারা নিজেদের অধিকার আদায়, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, শিক্ষা বিষয়ক আন্দোলন করবে। যা আগে ছিল, কিন্তু এখন তা হচ্ছে না। দলীয় লেজুড়বৃত্তির পাশাপাশি লেজের ভেতরেও তারা লড়াই করছে।

1 comment: